চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপলাইন ফুটোর কারণে প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পানি। মিমি সুপার মার্কেটের পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটি পানির ধারা দেখে মনে হতে পারে তা কোনো প্রাকৃতিক ঝরনা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ওয়াসার একটি ফুটো পাইপ থেকে বের হওয়া বিশুদ্ধ পানি। এলাকাবাসী জানায়, অন্তত তিন সপ্তাহ ধরে এই অবস্থা চলছিল। ওয়াসাকে বারবার জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরে একজন তরুণ ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করলে সিটি মেয়র সেটি শেয়ার করেন, এরপর দ্রুততার সঙ্গে পাইপ মেরামত করা হয়। একই চিত্র দেখা গেছে হালিশহরের ছদু চৌধুরী সড়কেও, যেখানে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পানি অপচয় হচ্ছে।
শুধু এই কয়েকটি এলাকা নয়, নগরের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে নিয়মিতভাবে পানি অপচয় হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় পৌনে দুই কোটি লিটার পানি অপচয় হচ্ছে পাইপ ফেটে যাওয়ার কারণে। বছরে যা দাঁড়ায় প্রায় ৬৪০ কোটি লিটার। ওয়াসার হিসাবে, এই পরিমাণ পানি উৎপাদনে খরচ হয় ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই অপচয় রোধ করতে ওয়াসা প্রতিবছরই কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে, কিন্তু অপচয় কমছে না। প্রকৌশলীদের মতে, পাইপলাইনের ফুটো বন্ধ করতে পারলে নগরের অনেক এলাকায় পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যেত।
চট্টগ্রাম ওয়াসার মোট আবাসিক সংযোগ রয়েছে ৮৬ হাজার ৪৭টি এবং বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে ৮ হাজার ৫১১টি। দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে গড়ে ৪৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হয়। এর ৯২ শতাংশ আসে হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে এবং বাকি ৮ শতাংশ আসে গভীর নলকূপ থেকে। তবে উৎপাদিত পানির একটি বড় অংশ গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না। গত এক বছরের হিসাব অনুযায়ী, গড়ে সাড়ে ২৬ শতাংশ পানি অপচয় হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৩.৯ শতাংশ পাইপ ফুটোর কারণে নষ্ট হয় এবং বাকি অংশ চুরি, অবৈধ সংযোগ ও মিটারে কারসাজির কারণে হারিয়ে যায়।
ওয়াসা জানিয়েছে, প্রতি হাজার লিটার পানি উৎপাদনে তাদের খরচ হয় ৩২ টাকা। এই হিসাবে বছরে ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকার পানির অপচয় হচ্ছে শুধু পাইপ ফুটোর জন্য। ওয়াসার অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরে প্রায় ২ হাজার ১৩৯টি পাইপ ফুটো হচ্ছে এবং সেগুলো মেরামতে খরচ হচ্ছে এক কোটি টাকার বেশি। এর বাইরেও চুরি, অবৈধ সংযোগ এবং মিটার জালিয়াতির কারণে বছরে আরও প্রায় ১৪২ কোটি টাকার পানির রাজস্ব হারিয়ে যাচ্ছে, যাকে তারা ‘রাজস্ববিহীন পানি’ হিসেবে উল্লেখ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির এই বিপুল অপচয়ের দায় ওয়াসা এড়াতে পারে না। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জানিয়েছেন, যে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কারিগরি অপচয় সহনীয় ধরা হয়। কিন্তু ওয়াসায় সেটি ২৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা চরম অব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দেয়। তিনি মনে করেন, এই বিশাল পরিমাণ অপচয়ের দায় শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, রাজস্ববিহীন পানির হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হলে ওয়াসাকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সংগঠনের নেতার অভিযোগ, ওয়াসা একটি দুর্নীতিপরায়ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। পানি উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ এবং রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে লুটপাট চলে। এর কোনো জবাবদিহি নেই। জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক সেবার জন্য ওয়াসাকে পুরোপুরি সংস্কার করা ছাড়া উপায় নেই।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী জানান, রাজস্ববিহীন পানি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার স্মার্ট মিটার বসানো হয়েছে এবং ৭০০ কিলোমিটার নতুন পাইপ বসানো হয়েছে। আরও ৩৮৩ কিলোমিটার পাইপ বসানোর কাজ চলছে। তবে ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে বাস্তব সমস্যার সমাধান হবে না।