বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অনেক নেতার নাম উঠে আসে, যাঁদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে বিতর্ক রয়েছে। তেমনই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। অনেকের মতে, তিনি রাজনীতিতে সহিংসতা ও দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। একদিকে দলীয় সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে যেমন রাজপথের রাজনীতিকে আগ্রাসী করে তোলেন, অন্যদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সহিংস কৌশল প্রয়োগ করেন—এমন অভিযোগ বহুবার উঠে এসেছে।
নানকের রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয় আশির দশকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র রাজনীতিতে ক্যাডার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে এবং অস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে ক্ষমতার দখল বজায় রাখতে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের পর নানক যুবলীগের নেতৃত্ব পান। এই সময়ে তাঁকে কেন্দ্র করে সংগঠনের কার্যক্রম আরও সংঘাতমুখী হয়ে ওঠে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মত দেন। আন্দোলন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, এবং প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনাগুলো এই সময় বেশ আলোচিত হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে নানকের বিরুদ্ধে 'সন্ত্রাসী রাজনীতি'র ভিত্তি স্থাপন করার অভিযোগ ওঠে।
বিশেষ করে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবরের 'লগি-বৈঠা'র ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেদিন রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ঢাকা শহরে সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটে এবং এই ঘটনা রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ঘটনার মূল পরিকল্পনায় নানকের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও বারবার সামনে এসেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই ঘটনার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়, যা পরে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের উত্থানে ভূমিকা রাখে।
এক-এগারোর সময় নানক বিদেশে অবস্থান করলেও ২০০৮ সালে তিনি দেশে ফিরে রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও দলীয় পদে ওমর ফারুক চৌধুরী ছিলেন যুবলীগের সভাপতি, বাস্তবে যুবলীগের নানান কর্মকাণ্ডে নানকের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, রাজনীতির পাশাপাশি তিনি একটি 'সশস্ত্র ক্যাডার' গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন যারা রাজনৈতিক কর্মসূচি দমন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, এবং শহরের নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার করত। বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ী এবং প্রতিপক্ষের ওপর ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা নিয়েও তাঁর নাম আলোচনায় এসেছে।
২০১৩ সালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিরোধী জোটের আন্দোলন শুরু হলে, সেই আন্দোলন দমনেও নানকের ভূমিকা ছিল বলেই অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, ছাত্রলীগ-যুবলীগের একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ, যাদের ‘হেলমেট বাহিনী’ নামে চিহ্নিত করা হয়, তারা বিরোধী দলের কর্মসূচিতে হামলা ও সহিংসতায় জড়িত ছিল। এসব কর্মকাণ্ডে নানকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল বলেই বিভিন্ন মহলে ধারণা প্রচলিত।
২০২4 সালের জুলাই মাসে দেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যায়। ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। অভিযোগ আছে, তখনো নানকের অনুসারীরা রাজধানীর মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা চালিয়েছিল। ক্যাম্পাসেও ছাত্রদের ওপর হামলা, ভীতি প্রদর্শন ও নির্যাতনের নানা অভিযোগ ওঠে।
তবে শেষ পর্যন্ত জনতার প্রতিরোধে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জনমনে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছায়—রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগ চিরস্থায়ী ক্ষমতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।